শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:
Logo চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের সৌজন্যে মতবিনিময় সভা কাল Logo আনোয়ারা তৈলারদ্বীপ বারখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন Logo গ্রেনেড হামলা মামলার রায়: বিভিন্ন জেলায় আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ Logo আনোয়ারা উপজেলায় গ্রাম আদালতের প্রচারণা Logo আনোয়ারায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে পিচ্চি জসিম আটক Logo সাতকানিয়ায়- নুরুছফা পরিবারের জায়গা দখলে  মরিয়া একটি প্রভাবশালী চক্র -ভুক্তভোগীর সংবাদ সম্মেলন Logo আনোয়ারা ওষখাইন রজায়ী দরবার শরীফ এ ফাতেহা ইয়াজদাহুম সুসম্পন্ন। Logo যৌথ বাহিনীর অভিযানে আনোয়ারার আবছার মেম্বার গ্রেপ্তার Logo বাঁশখালীতে কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে অসুস্থ অর্ধশতাধিক লোক Logo শুনানীতে চট্টগ্রাম আদালতে হট্টগোল বৃহস্পতিবারও আইনজীবীদের বিক্ষোভ এজলাস থেকে নেমে যান বিচারক।
নোটিশঃ
যে কোন বিভাগে প্রতি জেলা, থানা/উপজেলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘dainikalokitobangla.com ’ জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিক নিয়োগ ২০২৩ চলছে। বিগত ১ বছর ধরে ‘dainikalokitobangla.com’ অনলাইন সংস্করণ পাঠক সমাজে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাঠকের সংখ্যায় প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছে তরুণ, অভিজ্ঞ ও আন্তরিক সংবাদকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ‘dainikalokitobangla.com‘ পত্রিকায় নিয়োগ প্রক্রিয়ার এ ধাপ

পাঁচ ত্বরিকার পীর,রজায়ী ত্বরিকার ইমাম,৩৬ বছর বনবাসী, বাংলা সাহিত্যসহ বিভিন্ন গ্রন্থপ্রণেতা,লেখক,কবি ও দার্শনিক পীর মীর নূর মোহাম্মদ শাহ্ আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ্ (র:)’র জীবনী

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম / ২৭৮ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم

আউলাদে ছিদ্দিকে আকবর, পাচঁ ত্বরিকার পীর, ৩৬বছর বনবাসী, বিখ্যাত সাধক, ১৮শতকের মহাকবি,বেলায়তের সম্রাট, হযরত শাহ্ সূফী আল্লামা আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ্ (রহ:)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী…….

#লেখক
✒পীরে ত্বরিকত আলহাজ্ব মোহাম্মদ খোরশেদ উল্লাহ রজায়ী প্রকাশ (রজায়ী হুজুর) {মা.জি.আ.}
প্রতিষ্ঠাতা রজায়ী যুব ত্বরিকত কমিটি বাংলাদেশ

📌কবি সাহিত্যিক আউলিয়া ও সাধকের আকর্ষনীয় কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন গ্রামে এমন একজন মহাপুরুষ হযরতুল আল্লামা শাহ্ সুফি সৈয়দ আলী রজা (প্রকাশ কানু শাহ) (রঃ) ১১২১ মঘী মোতাবেক ১৭৫৯ ইংরেজী ১৭ই শ্রাবণ ১১৬৫ বাংলা ১০ ই রবিউস সানী রোজ সোমবার প্রত্যুষে এই আলো বায়ু ঘেরা পৃথিবীতে তশরীফ আনয়ন করেন। জন্মের পূর্বের কাহিনী: জন্মের ৩ বৎসর পূর্বে শবে বরাতের পুণ্যময় রাত্রিতে তাঁহার মাতা হযরত পরান বিবি (রঃ) দেখিতে পাইলেন এই আলো বায়ু বিশিষ্ঠ নিখিলের উদ্ভিদ জাতিরা সিজদায়, রাতে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। এই অবস্থা দেখতে পেয়ে ‘মা’ জননী জায়নামাজ বিছিয়ে সিজদায় পড়ে অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলে খোদার দরবারে রোদন করতে লাগলেন। সিজদা হতে ঐ সময় উঠলেন যখন ছরকারে দো আলম নুরে মোজাচ্ছম (দঃ) হযরত সিদ্দীকে আকবর, ওসমান গণী, ওমর ফারুখ ও আলী হায়দার (রঃ) কে লইয়া উপস্থিত হইলেন, আর বলিতে লাগিলেন, উঠ ‘মা’ উঠ, উঠ অতঃপর উঠিয়া দেখিলেন সিজদার জায়গায় স্বর্গ পুরীর মত সুগন্ধময় হইয়া গিয়াছে। এই ঘটনার দুই বৎসর পর তৃতীয় বৎসরে বাবাজান কেবলা এই পৃথিবীতে শুভাগমন করেন এবং সাত বৎসর বয়সে আপন পিতা হযরত শাহ সুফি সৈয়দ সাছি (রঃ) এর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তি করে এবং শাহ সুফি কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) সংস্পর্শে থেকে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষা গ্রহন করেন।

হযরত শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) এর পরিচয় ও বালক আলী রজা (রঃ) লেখা পড়ার দায়িত্ব ভার গ্রহণ কেয়ামুদ্দিন শাহা তান নাম আছিলেন্ত। বন ভক্ষি প্রাতে যেন প্রকাশ মার্তন্ড প্রকাশিল চাটিগ্রামে সে নাম অখন্ড। ফেনীর দক্ষিণে এক শহর উপাম। হাজীগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম। সেই শুভ গ্রামে ছিল তাহান বসতি। সে পীরের চরনে মোর সহস্র প্রণতি। (সিরাজ কুলুব)

হযরত সৈয়দ আমানত আল-আরবি (রঃ) হযরত শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দিন আউলিয়াকে (রঃ) খেলাফত প্রদান কালে বলেছিলেন হে বাবা কেয়ামুদ্দিন তোমার বিহার লক্ষ্ণৌতে কাজ নেই। তোমার কাজ আমার মুরশীদের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করা তাই অতিশীঘ্র তোমাকে খেলাফত প্রদান করিতেছি, রেয়াজত কর গিয়ে, পূর্ব বঙ্গের চাঁনখালী নদীর পশ্চিম পার্শ্বে যাও সেখানে হযরত সিদ্দিক আকবরের আওলাদ আলী রজা (রঃ) এর দেখা পাইবে তাহার হাতে আমার মুরশীদের দেওয়া আমানত নিয়ে চাঁনখালীর পশ্চিম পার্শ্বে বিভিন্ন এলাকায় প্রদক্ষিণ করে ১১৩০ মঘী রোজ বৃহস্পতিবার বে-চেইন অবস্থায় পরৈকোড়া বাজারে এসে পৌছলে তথায় বালক আলী রজার সাথে দেখা হয়, আলাপ চারিতার পর তাঁহার সাথে ওষখাইন গ্রামে এসে “মা” পরান (রঃ) এর সাথে সাক্ষাত করে বালক আলী রজার লেখা পড়ার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। এতদিন “মা” পরান বালক আলী রজার লেখা পড়ার চিন্তায় খুব উদগ্রীব ছিলেন। হযরত শাহ্ সুফি মৌঃ কেয়মুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) এর হাতে লেখা পড়ার ভার তুলে দিতে পেরে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন। বালক সৈয়দ আলী রজাকে আপন সংস্পর্শে রেখে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে ১১৩৪ মঘী সনে ১৩ বৎসর বয়সে আধ্যাত্বিক জ্ঞানের ছবক দান করেন।

হযরত শাহ্ সুফি আল্লামা সৈয়দ আলী রজা (রঃ) এর ভাষাগত যোগ্যতা: আপন রচিত আগমে রহিয়াছে। “আরবী, ফার্সী বাঙ্গলা ও পুরান।]
আগম, জ্যোতিষী আর নাগরী বিদ্যান।”

#পারিবারিক_জীবন: শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর সাংসারিকের দিকে উদাসীনতার ভাবপরিলক্ষিত হওয়ার ধন-সম্পদ নষ্ট হওয়ার আশংকায় এবং সংসারনুরাগী হওয়ার নিমিত্তে ১৪ বৎসর বয়সে ভিংরোল নিবাসী একজন মুহাজনের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জমিদার ফারুকী বংশের মেয়ে রকিম বিবি (রঃ)’র সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করা হয়। উক্ত বিবির গর্ভে হযরত শাহ আমিনুল্লাহ মিয়া ও শাহ এরশাদুল্লাহ মিয়া (রঃ) জন্ম হয়। বিধাতার বিধান না যায় খন্ডন। যে নিমিত্তে বিবাহ করাইয়াছিলেন। তাহা সম্পূর্ণ রুপে উল্টা ফল হইল। ফলে সংসারনুরাগীর স্থলে সংসার বিরগী হতে চললেন।

#সাধনা কাল: ১৩ বৎসর বয়সে হযরত মৌলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ কেয়ামুদ্দিন আওলিয়া (রঃ) হতে শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। এবং আল্লাহর হুকুমে গুরুর আদেশে মায়ের অনুমতিক্রমে ১৭ বৎসর বয়সে আল্লাহর ধ্যানে বিরল বাসী হন। উক্ত বিরলে ১২ বৎসর অতিবাহিত করার পর দেশে আগমন করেন।

#২য়_সাধনার কাল: প্রথম সাধনা থেকে আসার পর মায়ের নিকট সাধনা অপূর্ণ প্রমাণ হওয়ায় এবং অন্তরে কোন প্রকার শান্তি না পাওয়ায় আবারো সংসার ত্যাগ করে ভারত বর্ষের বিভিন্ন অরণ্যে পূর্ণ ১২ বৎসর সাধনা করে পূর্ণ কামালীয়ত লাভ করে বাঘে পিঠে সাওয়ার হয়ে মাতৃভূমি ওষখাইন গ্রামে আগমন করেন। সাধনা কালের একটি ঘটনা: হযরত শাহ্ ছুফি সৈয়দ আলী রজা (রঃ) সাধনার নিমিত্তে যখন পটিয়ার পূর্বে গভীর অরণ্যে কৌশিল্য পাহাড়ে গিয়ে পৌছেন, তখন পাহাড়ের তটে দাড়িয়ে অবস্থানের জন্য পাহাড় থেকে অনুমতি প্রার্থনা করিলে কোন প্রকার সাড়া না পাওয়ার দরুন উক্ত স্থানে ছয়মাস একপায়ে দন্ডায়মান অবস্থায় সাধনা করেন। অতপর তথায় গুরু হযরত শাহ্ ছুফি কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) হাজির হয়ে, তাহাকে পাহাড় থেকে সাধনার অনুমতি নিয়ে দিয়ে বিদায় গ্রহন করেন।

#২য়_বিবাহ: সুলতানপুর নিবাসী হযরত ওয়ায়েশ কাজী (রঃ) সাথে সাধনা থেকে আসার পথে দেখা হয় এবং চিন্তে মুজাদ্দেদের ইঙ্গিতক্রমে আপন মেয়ে আকিম বিবি (রঃ) কে হযরত শাহ্ ছুফি সৈয়দ আল্লামা আলী রজা (রঃ) হাতে তুলে দিয়ে খেদমতে আত্মোৎসর্গ করে দ্বাদশ বৎসর কাটাইয়া দেন। অতঃপর হযরত ওয়ায়েশ কাজী (রঃ) কে খেলাফত প্রদান করে সাতগাছিয়ায় গাউছুল আজম বড়পীর সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানীর (রঃ) আস্তানা শরীফে রেয়াজত করার জন্য পাঠাইয়া দেন, উক্ত বিবির গর্ভে শাহ্ শরাফত উল্লাহ্ মিয়া ও হযরত শাহ্ মনিরুল্লাহ্ মিয়া (রঃ) জন্ম গ্রহণ করেন।

#খেলাফত_লাভ: হযরত শাহ্ ছুফি সৈয়দ আল্লামা আলী রজা (রঃ) ২৯ বৎসর বয়সে হযরত শাহ্ ছুফি মৌলানা সৈয়দ কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) এর কাছ
থেকে চিস্তিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ত্বরিকার খেলাফত লাভ করনে।

#৩য়_সাধনা: বাবাজান কবেলা হযরতুল আল্লামা পীরানে পীর কুতুবে মাখতুব হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ পীর মীর আলী রজা (রঃ) ৩৬ বৎসর গভীর অরণ্যে সাধনা করে পূর্ন ১২ বৎসর গৃহ অভ্যন্তরে মশারী খাটায়ে সাধনা করে হযরত পেশওয়ায়ে ছালেক সৈয়দ জিয়াউদ্দিন আহাম্মদ আল বাগদাদী (রঃ) হতে কাদেরিয়া, নক্সবন্দীয় ও সরওয়ারদিয়া ত্বরিকার খেলাফত লাভ করে এবং মুজাদ্দেদ ও গাউছিয়াতের ক্ষমতা লাভ করে বেলায়তের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হন। এরপর এলহাম এর মাধ্যমে নিজ নামের সাথে সংযুক্ত করে রজায়ী তরিকার ইমাম হন।

হেন সাধু পৃথিবীতে না জন্মিবে আর। ৩৬ বৎসর ছিল সাধু বনে অনাহারে।

#জিয়া_উদ্দিন_আহাম্মদ_পেগুয়ায়ে_ছালেকের
পরিচয়: হযরত জিয়াউদ্দিন আহাম্মদ আল বাগদাদী (রঃ) হযরত গাইছুল আজম বড়পীল সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (রঃ) আওলাদ ও মজজুব ফকির ছিলেন। হযরতুল আল্লামা শাহ্ ছুফি সৈয়দ আলী রজা ওরফে কানু শাহ্ (রঃ) শুধু মাত্র আধ্যাত্মিক সাধক ফকির হিসাবে সিমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি ও আল্লামা ছিলেন, বাবাজান কেবলার সাহিত্য জীবনের আলোচনায় তাহা পাঠক সমাজের নিকট স্পস্ট হয়ে উঠবে বলে আশা করি।

#সাহিত্যিক_জীবন: নেপালের রাজ দরবার থেকে সংগৃহীত ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের ধর্মীয় সাধন সঙ্গীত তথা চর্যাপদ থেকে বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত হলেও আমরা মুসলিম সাহিত্যিকদের কাব্য পাই ষোড়শ শতাব্দীতে। কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর প্রথম মুসলিম সাহিত্যিকদের কাব্য পাই ষোড়শ শতাব্দীতে। কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর প্রথম মুসলিম কবি হিসাবে কাব্য রচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আঠারো শতকে তাত্ত্বিক সাধক, পীর, পন্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ কবি হযরতুল আল্লামা সৈয়দআলী রজা (রঃ) এর কাব্য কীর্তির পরিচয় পাই। সাধন মার্গে তিনি বৈষ্ণব, তন্ত্র, যোগ ও সুফি সাধনার আশ্চর্য সমন্বয় করেন। তাঁহার রচনায় একদিকে ইসলামী সুফি তত্ত্ব ও অন্যদিকে হিন্দু যোগতন্ত্রের সমন্বয় বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়। অষ্টাদশ শতকে জন্ম নিয়ে ও তিনি অসাম্প্রদায়িক ও উদারনীতির কবি ছিলেন। তিনি আরবী, ফারসী বাংলা, দেবনাগরী ও সংস্কৃতি ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। কবি শাহ্ ছুফি সৈয়দ আল্লামা আলী রজা (রঃ)’র লিখিত কাব্যগুলি দরবেশী গ্রন্থ। ইহাতে আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর আধ্যাত্ম প্রেমইপ্রাধান্য পেয়েছে। এরুপ গ্রন্থ স্বভাবতই দুর্বোধ্য হইয়া থাকে। ইহাতে নূঢ় আধ্যাত্মিক ভাবের যে সব কথা আছে, তাহা সাধারণ পাঠকের নিকট একান্ত দুরুহ বোধ হইলেও ভাবুকের নিকট প্রীতিপ্রদ হবে আশা করা যায়। বঙ্গ সাহিত্যে এ ধরনের গ্রন্থ আর নাই বলিলে অত্যুক্তি হবে না। গুরুপদেশ ব্যতিরেকে এরুপ গ্রন্থের মর্ম পরিগ্রহ করা ও অন্যকে বোঝানো সম্ভব নহে। তাঁহার শিষ্যে েমধ্যে ফয়দুল মুবতাদীও জ্ঞান চৌতিশা প্রণেতা বালক ফকির এবং ফয়দুল মুবতাদী ও গুলে বাকাউলী প্রণেতা মোহাম্মদ মুকিম ও মধ্যযুগের কবি ছিলেন আর তাঁহার ছেলেদের মধ্যে শাহ্ এরশাদুল্লাহ মিয়া (রঃ) পদাকার কবি এবং ছুরত নামা ও গ্রোহনাথ প্রণেতা শাহ্ শরাফতউল্লাহ মিয়া (রঃ) মধ্যযুগের কবি ও সাধক ছিলেন। আধ্যাত্মিক কবি হযরতুল আল্লামা শাহ্ ছুফি সৈয়দ আলী রজা (রঃ) যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেন তা হল:
১) গোপ্ত তত্ত্বের আগম, ২) শাস্ত্রীর আগম, ৩) দেহ বিচার আগম, ৪) জ্ঞান সাগর, ৫) সিরাজ কুলুব, ৬) ধ্যান মালা, ৭) শাহ্ নামা, ৮) সৃষ্টি পত্তন, ৯) যোগ কালন্দর, ১০) ষঠ চক্র ভেদ, ১১) ইসলাম নামা, ১২) খাবনামা,১৩) রাগতাল নামা, ১৪) রফিকুচ্ছালেকীন, ১৫) রাহাতুর রুহ, ১৬) তারিফে রাসুল (দঃ), ১৭) অমর সিং।

উপরোক্ত গ্রন্থগুলি বিশ্লেষন করিলে এতে কয়েক শ্রেণীর কাব্যের পরিচয় পাওয়া যায় যেমন:
১) প্রণয়োপাখ্যান, ২) মুলিম ধর্ম সাহিত্য, ৩) মুসলিম বৈষ্ণব পাদবলী, ৪) শাক্ত পদাবলী, ৫) সুফি সাহিত্য, ৬) সাওয়াল সাহিত্য, ৭) রাগতলা নামা, ৮) তাল মালা, ৯) করিরাজী চিকিৎসা শাস্ত্র, ১০) জ্যোতিষ শাস্ত্র, ১১) ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক মসায়েলা এছাড়া ও তিনি সাত শতাধিক ভাবমূলক, বন্দনা মূলক ও তত্ত্বমূলক মারফতী গান রচনা করেন। সাধক কবি শাহ্ সুফি সৈয়দ আলী রজা (রঃ) এর সুফি সাহিত্য, আধ্যাত্মতত্ত্ব ও দরবেশী গ্রন্থের আলোচনার পূর্বে সূফী দর্শন বিষয়টি কি? এ বিষয়ে সামান্য আলোচনা করা প্রয়োজন। ভারতে তথা বাংলার সুফি মতবাদের বিভিন্ন শাখা ভারতীয় সাংখ্য যোগতন্ত্রের প্রভাবে স্থানিক ও লৌকিক রূপ লাভ করেছিল। অধিকাংশ সূফি ছিলেন অদ্বৈতাবাদী এবং দেহতত্ত্বরসিক। তাই তারা ছিলেন যোগ সাধনা প্রবণ। মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে বাঙলা পাক ভারতে (ক) চিশতিয়া, (খ) কাদেরিয়া, (গ) ছরওয়ারদিয়া, (ঘ) নকশবন্দিয়া এ চারটি মতবাদই প্রধান। অন্যান্য গুলো এ চারটির উপমত। সুতরাং শাত্তারিয়া, মদারিয়া, কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রত্যেকটি উক্ত চারটির যে কোন একটির উপমত। ১) অদ্বৈতবাদ, ২) সর্বশ্বেরবাদ, ৩) দেহ তত্ত্ব, ৪) বৈরাগ্য, ৫) ফান তত্ত্ব, ৬) সেবাধর্ম ও মানব প্রীতি, ৭) গুরু বাপীর বাদ, ৮) পরব্রহ্মা ও মায়াবাদ, ৯) ইনসানুল কামেল তথা সিদ্ধপুরুষবাদ, ১০) স্রষ্টার লীলাময়তা প্রভৃতি ধারণার বীজ বা প্রকাশ ছিল আরব ইরানের সুফি তত্ত্ব ভারতে বিভিন্ন সুফি মতের উপর স্থানিক প্রভাব পড়েছে প্রচুর। নকশবন্দিয়া মতবাদে ও সাধন তত্ত্বে ভারতীয় দেহতত্ত্ব ও যোগের প্রভাব পড়েছে সবছেয়ে বেশী। বাঙলা পাক ভারতে সাধারণত ইলাম প্রচার করেন সুফি দরবেশরাই। অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর। পূর্ব পুরুষের ধর্ম দর্শন ও সংস্কার মুছে ফেলাও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। সুফি সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানেরা শরীয়তের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয় নি অশিক্ষার দরুন। কাজেই সুফি তত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য সামঞ্জস্য দেখা গেছে সেখানেই অংশগ্রহন করেছে মুসলমানেরা। বৌদ্ধানাথপন্থা সহজিয়া তান্ত্রিক সাধনা, শাক্ত তান্ত্র যোগপ্রভৃতি এভাবে করেছে তাদের আকৃষ্ট। এ রুপে তারা খাড়া করেছে মিশ্র দর্শন। ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন পীর দরবেশ ফকির আউলিয়া প্রভৃতিদের প্রচার এবং কেরামতে ফলে মুখ্যত ব্রাহ্মনদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ন বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতের বাঙালী ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। মুসলমানদের বিশ্বাস হযরত মোহাম্মদ (দঃ) হযরত আলী কে তত্ত্ব বা গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান। হাসান হোসেন, খাজা কামিল বসোরী (মৃঃ ৭২৮ হীঃ), রাবিয়া (মৃঃ ৭৫৩ হীঃ) ইব্রাহীম আদহাম (মৃঃ ৭৭৭ হীঃ) আর হাশিম (মৃঃ ৭১৫ হীঃ) প্রমুখ। সুফি মতের আদি প্রবক্তা।

আল্লাহ আকাশ ও মর্ত্যের আলো স্বরুপ। আমি তার (মানুষের) ঘাড়ের শিরা থেকেও কাছে রয়েছি। (আল কোরআন)। এই প্রকার ইংগিত থেকে সুফিমত এগিয়ে যায়। বিশ্বব্রহ্মা বা সর্বেশ্বরবাদের তথা অদ্বৈতবাদের দিকে জিকির বা জপ করার নির্দেশ মিলেছে। কোরআনের অপর এক আয়াতে অতএব (আল্লাহকে স্বরণ কর)। কেননা- তুমি একজন স্মারক মাত্র। সৃষ্টি ও স্রষ্টার অদৃশ্যলীলা ও অস্তিত্ব বুঝাবার জন্য বোধি তথা ইরফান কিংবা গুহ্য জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। আগম: পুণির নাম ‘আগম রচয়িতা সাধক কবি আল্লামা সৈয়দ আলী রজা (রঃ) আগম গ্রন্থকে ৩টি স্বাতন্ত্র বিষয়ে রচনা করেছেন ইহা হইল, ১) শাস্ত্রীর আগম, ২) দেহ বিচার আগম, ৩) গোপ তত্ত্বের আগম। বিষয়:-

“প্রভুর গোপন তত্ত্ব মারফত যে হয়।
সেই মারফত নাম আগম বলয়।”

ইহা থেকে বুঝা যায় এই কাব্যটি গোপন তত্ত্বের বহি। গুরুপদেশ ব্যতিরেকেও এরুপ গ্রন্থের মর্ম পরিগ্রহ করাও অন্যকে বুঝান সম্ভব নহে আগম কাব্যের সূচীতে আমরা পাই ১) স্তুতি, ২) সৃষ্টি, ৩) পত্তন, নূর তত্ত্ব, ৪) চার মঞ্জিল, ৫) জলবায়ু তত্ত্ব, ৬) মনতত্ত্ব, ৭) আল্লাহ তত্ত্ব।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম
আরম্ভ: প্রথমে প্রণাম করি আল্লাহ নৈরাকার। গোপ্ত ব্যক্ত ত্রিভূবন সৃজন জাহার।

শেষ: মহামায়া দারুন করিছে করতার। মায়া ডোবে মূলে বান্দি রাখিয়াছে সংসার। জুগিকুলে মায়াজাল পুড়ি ভস্ম করি। সর্ব্ব ত্যাজি দৃঢ় মনে ইশ্চিল ফকিরি।

শরিয়ত্তত্ত্ব:
শরা সকলে মূল জানি ও নিশ্চয়। শরীয়ত গুরু হয় মারফত শিষ্য। ‘শরা’ বিনু না পাইব আগম উদ্দিশ্য।

আবার: তন শরীয়ত হ এ’মন’ তরিকত। হাকিকত ‘পবন’ ঈশ্বর মারফত।

#জ্ঞান_সাগর: সাধক কবি আল্লামা সৈয়দ আলী রজা (রঃ)’ বিখ্যাত সুপ্রসিদ্ধ ও বহুল প্রচারিত কাব্য। “জ্ঞান সাগর” ইহা একখানা আধ্যাত্ম তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। ইহাতে মুসলিম সুফিমত ও হিন্দু যোগ দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। জগত ও জীবন সম্বন্ধে মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসাই এ কাব্যে রুপ পাইয়াছে। ইহা একটি সুফি সহিত্য বিষয়ক পুঁথি জ্ঞান সাগর পুস্তকটি ইসলামী তত্ত্ব কথায় পূর্ণ হইলে ও কবি যে হিন্দুর আগম নিগম যোগ ও তন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তাহা এই পুস্তিকা হইতেই জানা যাইতেছে। করতার নিরঞ্জন আল্লাহ রাসুল এবং মোহম্মদ (দঃ) ও অন্যান্য নবীদের বর্ণনাও দার্শনিক তাৎপর্য, বিশ্ব বিশ্ববিধান ইত্যাদি নানা তত্ত্বকথা দার্শনিক ও তত্ত্ব জ্ঞানীর দৃষ্টিতে কবি আলোচনা করিয়েচেন।
কোথাও তিনি কোরআনের বিশুদ্ধ অদ্বৈততত্ত্বের পট ভূমিকায় বলিয়াছেন।
এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর এক তন এক মন আপে একেশ্বর। ত্রিজগত এক কায়া এক করতার।
এক প্রভূ সেবে জপে সব জীবধর। প্রভু মূল হএ বৃক্ষ ডাল মোহম্মদ ফল ফুল হএ নর পাত সে জগত।

আবার কোথাও কোথাও হিন্দু যোগ নিদর্শনের গূঢ় কথা হিন্দুর মন লইয়াই আলোচনা করিয়েছেন। শুন্যেত পরম হংস শুণ্যে ব্রহ্মজ্ঞান যথাতে পরম হংস তথা যোগধ্যান যে জানে হংসের তত্ত্ব সেই সর যোগী সেই সব শুদ্ধ যোগী হএ শূণ্য ভোগী।
অসাম্প্রদায়িক কবি আদম হাওয়া, মহাদেব গৌরীগঙ্গা আয়েশা মোহাম্মদ প্রভৃতিকে প্রেমরসে নিমজ্জিত করিয়েছেন কবি জ্ঞান সাগরের বহু স্থলে সহজিয়া বৈষ্ণব ধরণের প্রেমরস ব্যাখ্যা করিয়েছেন কোথাও বা পরকীয়া প্রেমতত্ত্ব গ্রহন করিয়াছেন। এমনকি উল্টা সাধন, চন্দ্রসাধন প্রভৃতি গুহ্যাতিগ্রহ্য সহজিয়া সাধন সংক্রান্ত তত্ত্বকথা ও তিনি জ্ঞান সাগরে ইঙ্গিতে বলিয়াছেন। মাঝে মাঝে কবি আল্লাহ, রাসুল, ফাতেমা জননী, সাহাবাগণ এবং অন্যান্য নবীদের কথা বলিলেও যোগতন্ত্র হটযোগ বাউল সহজিয়া বৈষ্ণব প্রভৃতির গুহাতিত কায়াসাধনা প্রেম ও মুক্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গই “জ্ঞান সাগরে” বাদ যায়নি। তিনি স্বয়ং ফকির বা দরবেশ ছিলেন। তাই এই তত্ত্বগ্রন্থে ইসলাম ধর্মের প্রসঙ্গও আছে পকির বা দরবেশ ছিলেন। তাই এই তত্ত্বগ্রন্থে ইসলাম ধর্মের প্রসস্ত্র আছে পকিরী আদর্শের কথাও আছে। সুখ দুঃখে অবিচলিত থাকার যে দর্শন এ কাব্যে প্রচারিত হয়েছে, তা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের একটি বলিষ্ট দৃষ্টি ভঙ্গি গড়ে তোল খুবই সহায়ক এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন।
দুক্ষ পাই সুখ না মাগিব প্রভূস্থানে। এক চিত্তে ইশ্বর সরিব মনে মনে। দুখের সুখের দিকে মন না রাখিব সনা এ ঈশ্বর নাম স্বরণ করিব।

জ্ঞান সাগর গ্রন্থটি ৩৪৭২ লাইনে লিপিবদ্ধ সুচি পত্রের মধ্যে রয়েছে।
(১) প্রথম পয়ার (২) রাগ ধানষি (৩) রাগ সুদ্দবসন্ত খর্ব, (৪) গুরু ভজন ও পরিচয়, (৫) রাগ বসন্ত খর্ব্ব, (৬) তুরি রাগ বসন্ত (৭) খর্ব্ব ছন্দ হে সুন্দরা (৮) বিষু রিতু (৯) রাগ পঞ্চম (১০) গুরু সেবা (১১) বগা হিল্লোল ও (১২) ফরিদের রোদন।
গ্রন্থের প্রারম্ভঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম

জিজ্ঞাসিল শাহ্ আলী রসুলের পাশ।
কি কর্ম করিলে হৃদ হইব প্রকাশ।
কি কর্ম করিলে হএ চিত্ত অন্ধকার।
এই কর্ম ভগ্ন করি কহ নবিস্বার

গ্রন্থের শেষঃ এই পুস্তকের নাম ধরে জ্ঞান সাগর-

মধুর মাধুরী সব অমিয়া লহর।
গুরু বলে নানা ছন্দ আর বহু রঙ্গ।

গুরু আলী রজা ভূনে আগম প্রসঙ্গ। সিরাজ কুলুবঃ এর অর্থ “হৃদয় সমূহের প্রদীপ”। এ গ্রন্থ শরা শরিয়তের বিষয় অবলম্বনে শরিয়তের বিষয় অবলম্বনে শরিয়তের মসায়েলার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ইহাকে আমরা ইসলামী ধর্ম বিজ্ঞান মূলক কাব্য ও সাহিত্য বলতে পারি। কবি এই গ্রন্থে পৃথিবীর অবস্থান, বেহেস্তের সংখ্যা আল্লাহ্ কোনদিন পৃথিবী সৃষ্টি করেন, কেয়ামত কালে এবং পরে কি হবে? এসব বিষয় এ কাব্যটি যে উত্তম মসায়েলার কথা পরিপূর্ণ তা আমরা কবির গ্রন্থ উৎপত্তি বিষয়ক মন্তব্যে পাই। কবি বলেন।

সিরাজ কুলুব গ্রন্থটি ২৪টি বিষয় নিয়ে রচিত। বিষয় গুলিঃ
১। প্রেম তত্ত্ব, ২। পীর ‘প্রশস্তি, ৩। গ্রন্থোৎপত্তি, ৪। সৃষ্টি পত্তন, ৫। সপ্ত আসমান পরিচিতি, ৬। জগৎ সৃষ্টি, ৭। পঞ্চ কর্তব্য, ৮। পৃথিবীর ধারক, ৯। দিগরঃ মসল, ১০। অষ্ট স্বর্গ পরিচিতি, ১১। নরক পরিচিতি, ১২। পক্ষী পরিচিতি, ১৩। হাউজ-ই-কওসর, ১৪। আর্শের ধারক, ১৫। নবী পরিচয়, ১৬। আজ্রাইল পরিচয়, ১৭। মনকীর নকীর পরিচয়, ১৮। মহম্বর তত্ত্ব, ১৯। কুহকাক পরিচয়, ২০। ইস্রাফিলের শিঙ্গা, ২১। সংখ্যা প্রতীক। কবি প্রথমেই আলীর প্রতি রাসুলের উপদেশচ্ছলে আধ্যাত্মা প্রেম ব্যাখ্যা করেছেন।

কবির ভাষায়-
প্রেম ভাবে করতারে সৃজিলা রসুল
তেকারণে ত্রিভুবন পিরীতি আমুল।

অতএব প্রেম ভাবে কর আলী পরম সাধনা। রসুল এই প্রেমতত্ত্ব (মারফত) কেবল আলিকেই জানিয়েছিলেন। পীর প্রশস্তি ও গ্রন্থ উৎপত্তি সম্মন্ধে বলেছেন কবি পীর শাহ্ কেয়ামুদ্দিন একজন ওলেমা, পীর ও দরবেশ ছিলেন। কবি তাঁহার জবান থেকে মসায়েলা সংগ্রহ করে এ কাব্য খানি রচনা করেন। ইহুদীর প্রশ্ন তুলে ধরা হল। কবির প্রথম মসলা হচ্ছে সৃষ্টির উৎস সম্মন্ধীয়।

প্রশ্ন: প্রথমে কিরুফে প্রভু অম্বর করিল?

উত্তর: এক রীল মানিক্য যে আলালা এ সৃজিল প্রথম করিয়া তাতে দৃষ্টি নিরক্ষিল দৃষ্টি জোতে ঘর্ম জন্মি সমুদ্র হইল তাতে ভাব লক্ষ্যে সেই সিন্দু উথলিল তুফান জন্মিয়া ধুম হইল সাগরে সাগরের অর্ধ দুম্র উঠে শুণ্য পরে। সেই ধূম্র মিলি এক চাক হৈল বড় এক খন্ডে সপ্ত করিল অম্বর।

তারপর সপ্ত আকাশ বর্ণিত হয়েছে। ১ম আকাশের নাম ‘গগন’ নীল জমরুদ শিলায় নির্মিত। মিরিস্তাঃ বরকিয়া, ২য় আকাশের নাম ‘কয়লুচ রজত’। ফিরিস্তাঃ আকাইল। ৩য় আকাশের নাম ‘পুস্কর’ ৪র্থ আকাশের নাম ‘মাউত’ তৃতীয় ও চতুর্থ আকাশ লাল এয়াকুত দ্বার নির্মিত। ফিরিস্তা কৈদুপাম। ৫ম আকাশের নাম বিয়া। লাল এয়াকুত দ্বারা নির্মিত। ফিরিস্তা ইসমাইল। ৬ষ্ঠ আকাশের নাম কর্ণি জরদ এয়াকুত দ্বারা নির্মিত ফিরিস্তা রোযাইল। ৭ম আকাশের নাম লামকান নুর জরদ এয়াকুত দ্বারা নির্মিত ফিরিস্তা দারাইল।
তৃতীয় মসলায় জগৎ সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ্ পাক কোরানে ইরশাদ করেছেন ছয়দিনে জগতের যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু তৈরী করেছেন। কবি তৃতীয় মসলায় জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁহার পদে যাহা লিখেছেন তাঁহার সারমর্ম হল রবিবারে সৃষ্ট হয়েছে ত্রিভূবন ও আকাশ। সোমবারে তৈরী হয়েছে চাঁদ সূর্য ও নক্ষত্র। মঙ্গলবারে উদ্ভুত হয় ফিরিস্তারা। বুধবার নির্মিত হয় সিন্ধু চুড়া গিরি এবং নির্ধারিত হয় অন্ন ও মৃত্যু (রিযিক ও মাউত)। বৃহস্পতিবারে সৃষ্টি হয় স্বর্গ, নরক নরকের কর্মীরা
এবং হুর গণ শুক্রবার হয় আদম হাওয়ার সৃষ্টি। চতুর্থ ‘মসলায়’ পাঁচটি কর্তব্যের উল্লেখ্য রয়েছেঃ-

পঞ্চ কর্ম করিবেক জান শীঘ্রগতি
আচম্বিত না করিব কোন কার্যনীতি।
১-২ প্রথমে ‘তওবা’ দ্বিতীয় এ “অন্ন” খাইব।
৩. তৃতীয় পাইলে কর্জ শুধিব শুকিব।।
৪. চতুর্থেত সুতা বিভা দিব যোগ্যমান।
৫. যার যেই সমে ক্রমে করিব সে ঘ্রান।

পঞ্চম মসলায় রয়েছে ধারকের পরিচয়ঃ- কৃশানুর (অগ্নির) উপর সমীর তার উপর লুসিয়া নামের মৎস্য মাছের উপরে রয়েছে রহিম তবক। তবকের উপর • দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্ণ। ঐ বৃষ্ণের সঙ্গে আছে এ এয়াকুত শিল সে শিলার ঘন হচ্ছে পঞ্চশত অব্দ পন্থ পরিমাণ। এসম্পকে অন্যমত ও রয়েছে। আর এক হাদীসে রসুল (দঃ) কহিছে। অন্ধকারের উপরে রয়েছে সমীর, সমীরের উপর ‘মশা’ মশার উপরে ফিরিস্তা, ফিরিস্তার উপরে কম কম ভূমি। তার উপরে আছে বৃষ। বৃষের উপরে রয়েছে পাষাণ। পাষাণের উপরে আছে মৎস, তার উপরে রয়েছে জল এবং জলের উপরে ভাসছে পৃথিবী।
৬ষ্ট মসলায় স্বর্গের এবং ৭ম মসলায় নরকের পরিচয় পাওয়া যায়ঃ- অষ্টম মসলায় আছে পক্ষীর বর্ণনা এ পক্ষী এতিম আলাম বর্ণিত “হুমা” নয় এ নাম কুর্বাস। আল্লাহর আরশের নিচে রয়েছে মানিক্য নির্মিত এক স্তম্ভ। সেই স্তম্ভের উপতে বসে আছে কুর্বাস।

তাম্রচুড় আকার যে সেই পক্ষী রেখা।
চতুর্থ হাজার ধরে সে পক্ষীর পাখা।

নবম মসলায় বর্ণিত হয়েছে হাউজ-ই-কওসার। এটি স্বর্গের নদী

সেই সিন্দু আর্শ নীচে স্বর্গের ভিতর ফেরদৌসের হোন্তে জল বহে নিরন্তর।

আর ফেরদৌসে রয়েছে স্বর্গের বৃক্ষ তুবা, বহু শাখাপত্র তাতে ফিরিস্তা বসতি। দশম মসলায় আল্লাহর আর্শের ধারকের কথা আছে আর্শের চার জন ধারক ফিরিস্তাকে আর্শ হামিনান বলে।

একাদশ মসলায় নবীদের পরিচিতি রয়েছে। এক লাখ চল্লিশ হাজার পয়গাম্বরের মধ্যে তিন শত তের মুসলমান নবীবর। এবং এসব নিকটে হৈল জিব্রাঈাল নজুল।

তাতে সপ্ত নবীবর প্রধান আছিল
এ সবেরপরে প্রভূ কেতাব সৃজিল।

এরা হচ্ছেন শিশ, ইদ্রিস, ইব্রাহিম, দাউদ, মুসা, ঈসা, ও হযরত মুহম্মদ (সঃ) মোট একশত চারি কেতাব সঞ্চার হৈল।

রমজান চান্দে সব কেতাব নামিল।
এসব কেতাবের মধ্যে প্রধান হচ্ছে-
শিশপরে উত্তরলি পঞ্চাশ ‘সইফা’
ইদ্রিসেত কেতাব যে আছিলেক ত্রিশ (ত্রিশ)
ইব্রাহিম পরে কেতাব হইলেন্ত বিশ
তৌরাত পাইল মুছা জবুর দাউদ
ইঞ্জিল পাইল ঈসা কোরআন মোহম্মদ।

ইব্রাহিম নয়শ বছর পরে মুসা দুই হাজার বছর পরে দাউদ তাঁর দুই হাজার বছর পরে ঈসা এবং তাঁর তিন হজার বছর পরে হযরত মোহম্মদ (দঃ) আল্লাহর কিতাব পেয়েছিলেন। দ্বাদশ মসলায় বলা হয়েছে যে আজ্রাইলঃ

চতুর্থ অম্বর পরে আসন করন্ত।
সংসারের যথ সব জীবন হরন্ত।

সপ্ত আকাশের উপরে রয়েছে ইল্লিন মোকান মৃত পূণ্যবান ব্যক্তিরা হাসর অবধি সেখানেই থাকবে। আর সপ্তম পাতালে রয়েছে সিজ্জিন মোকান অর্থাৎ বন্ধীখানা সেখানে হাসর অবধি থাকবে পাপাত্মারা। ত্রয়োদশ মসলায় মনকীর নকীরের কথা আছে। এই দুই ফিরিস্তা “মৈয়ত দাফন কৈলে গোরেত আসেন এবং মৃত ব্যক্তিকে তিনটে প্রশ্ন করে।

তোহোর ঈশ্বর কোন মান কারদ্বীন কোন কিতাবেত ইমা কহ তারচিন?

এতে বুঝা যায়, মনকীর নকীর হচ্ছে মুসলিম চিত্রে গুপ্তের দপ্তের আগন্তকের নাম ঠিকানা লিখা।

চতুর্দশ মসলায়ঃ “মহাম্বর” এর বর্ণনা আছে। মহম্বর একটি মসজিদ। এটি চারটি আকাশ ব্যাপি বিরাজমান এবং দৈর্ঘ্য পাঁচশ বছরের পথ। এর গঠন সুজুতি অতিঝলকে সুন্দর এর এক কোন লাল এয়াকুতে, দ্বিতীয় কোন নীল জমরুদে তৃতীয় কোন খাঁটি সোনায়। চতুর্থ কোন শুভ্র রজতে নির্মিত। এই মসজিদে ফিরিশতারা জুমাবারের নামাজ পড়ে। ইস্রাফিল আজান দেন। জিব্রাইল ইমামতি করেন মিকাইল খুৎবা পড়েন এবং আজ্রাইল নামাজে তকবীর বলেন।
পঞ্চদশ মসলায়ঃ রয়েছে “কুহকাফ” পরিচয় “কুহকাফ” পৃথিবীর পাঁচটি পর্বতের অন্যতম। এই পর্বত গুলো স্থাপন করেই আল্লাহ পাপময় পৃথিবীর কম্পন বন্ধ রেখেছেন। কবির ভাষায়

পশ্চিমে সুমেরু পূর্বে পর্বত কৈলাস।
হিমালয় উত্তরে ময়লার দক্ষিণে বাস।
কুহকাফ নামগৃহ সৃজন আল্লার।
নীল বর্ণ পাষাণে যে গঠন তাহার।
ষোড়শ মসলায়ঃ ইস্রাফিলের শিঙ্গার কথা আছে।

সে সিঙ্গার সপ্ত ডাল অতুল প্রমাণ।
পঞ্চ শত অব্দ দীর্ঘ পন্থ পরিমাণ।

• এই মসলায় বিস্তৃত ভাবে কেয়ামত ও বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর আদেশে ইস্রাফিল শিঙ্গায় ফুক দিলেই কেয়ামত হবে। তিন বৈনাশিক ফুকে বিশ্ব সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর চল্লিশ বছর পরে আল্লাহর নির্দেশে হাশরের আগে আর্শের নিন্মস্থ এয়াকুত নদীর জল দিয়ে চল্লিশ দিন বৃষ্টিপাত করা হবে। এই বৃষ্টির জলের • স্পর্শে সব কিছু হাশরের জন্যপুনরুজ্জীবিত হবে।

সপ্তদশ মসলায়: সপ্তম অস্বরের কুঞ্জী শাহাদাৎ কালেমায় কথা আছে। অষ্টাদশ মসলায় অন্যান্য কিতাবে কি কি নামে হযরত মোহাম্মদের (দঃ) নাম উল্লেখ • রয়েছে তা বর্ণিত হয়েছে। যেমন তৌরাত “তাবাতাত” ইঞ্জিলে “মৈদমৈদ”জবুরে “ফাকলিতা” আকাশে “আহমদ” পৃথিবী “মুহাম্মদ” নরকে ‘মহম্মদুন’ জান্নাতে নামাদাইন নামে অভিহিত হয়েছেন।
উনবিংশ মসলায় আকাশ ও স্বর্গ নরকের কথা আছে।

“নরক উপরে হএ স্বর্গের যে নাম
দুই মধ্যে যে রহে বৈকুন্ট তার নাম।”

বিংশ মসলায় ইহুদী নবীর কাছে প্রশ্ন করল এক, দুই, তিন, চার ও পাঁচ প্রভৃতি কার বা কিসের প্রতীক?

নবীর উত্তর: এক আল্লাহ জগপতি বর্জিত দোসর
দুতী এ আদম হাওয়া তিনে ত্রিভূবনে, উত্তম কেতাব চারি আল্লাহ সৃজন।

এমনি করে পাচঁ নামাজের, ছয় সৃষ্টির ছয়দিন। সাত স্বর্গের, আট ফিরিস্তার। নব মুসা লব্দ নয় আয়াত। দশ দশাক্ষর বীজ মন্ত্রের (দশ অক্ষর নাম আছএ গোপত) • এগারোজন প্রধান নবীর আদম, নূহ, ইব্রাহিম, ইউসুফ, আইয়ুব, ইউনুচ, মুসা, • দাউদ, সোলেমান, ঈসা আর মোহাম্মদের প্রতীক। বারো ইমাম আলী, হাসান, – হোসেন, জয়নুল বাকর, ফকির, তকী আশকর, মুসা ও ভাবী ইমাম মেহেদী একবিংশ মসলায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের উদ্ভব তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। এমনি করে – সপ্ত বিংশ প্রতীক বর্ণিত হয়েছে।
ইহুদীর প্রশ্নঃ
শুনিয়া কহিল নবি তাহার উত্তর।
ফজরেতে দুই গানা আদমের পর।
চারিগান জোহরেত ইব্রাহিমে পাইল।
আসরেত চারিগানা ইনুসেত হৈল্
তিনগানা মাগরিবে গুজারিল ঈসা।
এশাতে যে চারিগানা করিলেন্ত মুসা।
তিন গান বিতির সে মুস্তফা করিল।
পঞ্চ অক্তে নবী ষষ্ট নামাজে পাইল।

সিরাজ কুলুব গ্রন্থের শুরুঃ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ত্রিজগত সার।
যার প্রেম হইল নবী রসুল প্রচার।
প্রেমভাবে করতারে সৃজিলো রসুল।
তেকারণে ত্রিভুবন পিরীতি আমূল।
প্রেমের ভাবতে আল্লা কৈলা মোহম্মদ
প্রেম সখা নুর নবী জগত সম্পদ।

গ্রন্থের শেষঃ
পূর্বে মোশরিক বুলি ধরে তার নাম।
পশ্চিমেত মগরিব নাম সে উপামা।
উত্তরে সিমাল নাম জুনুব দক্ষিণ।
চতুর্দিকে চারি নাম জান তার চিন।

শাহনামাঃ বিষয় নবী আলী সম্বাদ। ইহা একটি ব্যবহারিক নীতি উপদেশ মূলক গ্রন্থ, আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর প্রতি হামদ ও না’ত দিয়ে গ্রন্থ শুরু করেন কবির ভাষায়।

প্রথমে প্রণাম করি আল্লাহ্ নৈরাকার
যার আজ্ঞা পরে হৈল এ সমস্ত সংসার
দ্বিতীয় রাসুল পদে করম প্রণাম।
যার প্রেমে কৈল প্রভু সকল আলম।

পীরস্তুতি তে গুরু শাহ্ কেয়ামুদ্দিনকে স্মরণ করেন। এরপরে ভাষা বন্দনায় কবি বলেনঃ

বাংলাদেশে মাজে বাংলার বচন
হিন্দুয়ানী শাস্ত্রের কথা জানে সর্বজন
নানাদেশের নানা ভাষা আল্লাহর সৃজন
সর্ব ভাষা শুদ্ধে বুঝে এক নিরঞ্জন।
নানা দেশে নানা ভাষা নানা শাস্ত্রে কয়,
দেশি ভাসে প্রভু সেবা ইশ্বর সদয়।
যে পন্ডিতে না বুঝিছে সর্ব্ব শাস্ত্র ভাষা,
সে সকলে অন্য শাস্ত্র করে উপহাস।
কবি আত্ম পরিচয় দিতে গিয়ে বলেনঃ-
চক্রশালা গ্রামের পশ্চিম ভাগটায়
শুদ্র এক নদী তার চাঁন্দ খালী নাম হয়
তাহার পশ্চিম ভাগে বসতি আমার
গ্রাম সে উত্তম নাম গন্ধব্য জোয়ার। (ওষখাইন)

সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ্ রাসুল ও সৃষ্টিপত্তন রাসুল ও আলী সম্বাদে এই তিনটি বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মহত্বের গুন প্রথম নং লজ্জা দ্বিতীয় মূর্খতা। লজ্জা সম্বন্ধে কবি বলেন। লজ্জা হচ্ছে ঈমানের শাখা, চাঁদ ছাড়া রাত্রি যেমন মূল্যহীন, বিদ্যা বুদ্ধি ছাড়া মানুষ ও তেমন মূল্যহীন, লজ্জা ছাড়া সকল বস্তু একবার নষ্টহলে তা আবার সৃষ্টি করা যায়, ধন ও বিদ্যা একবার হারাইলে পরিশ্রমে তা আবার পাওয়া যায়। কিন্তু লজ্জা একবার হারাইলে তা আর পাওয়া যায় না। কবি-ভাষায়।

লজ্জা বিনু যতবস্তু আছয় সংসারে।
ভাঙ্গিলে সকল বস্তু জোরাইতে পারে।
ধন বিদ্যা হারাইলে পায় পরিশ্রমে
শরম হারায় যদি না পায় জনমে।

নরপতির ক্ষমতা ও গুনাগুন, রাজ্য সুশাসন পদ্ধতি, দানমহাত্যু, অধর্ম পরিচিতি। রাজনুগত্য, দাতার দায়িত্ব, অতিথি সেবার সম্বন্ধে কবির মন্তব্য তুলে ধরা হল। কবি অতিথির সেবা সম্বন্ধে বলেন অতিথির আত্ম তুষ্টিতে নিজেকে আন্তরীক ভাবে সপে দিয়ে যতটুক সম্ভব তাদের মনতুষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর সনাতুষ্টি লাভ করা সম্ভব। পাশাপাশি নিরাশ না করে অন্তত প্রেম ভক্তি দিয়ে বিদায় করিও। গুরু পত্নী নিকাহ, ও গুরু মাহাত্ম্য ছাড়া ও ভক্তি হীন শিষ্যের দুর্ভোগ সম্বন্ধে কবি বর্ণনা করেন।

বিরস বিমূখ শুরু যার পরে হয়।
যথা খায় তথা আর নাহি সিদ্ধি জয়।
একে একে তার দোষ বিচারি কহিব।
প্রথমে নতুন বয়েশ অবশ্য মরিব।
নতুন কোন সংকট পরিব তাহার।
শুন্যবাদে পরি দুঃখ পায় গুরুতর।
মহাপাপ ঘৰ্ম্মপন্থে কবির গমন।
ভাগ্যযষ দিনে দিনে হৈবি ঘটন।
মুখচন্দ্র ললাটের জ্যোতি হৈব দুর।
বুদ্ধি বল ভাঙ্গি তার গর্ব্ব হৈব চুড়।
রোগে জড়ি সর্ব্ব অঙ্গ হৈব খন্ড খন্ড।
খসি খসি পরিব তার মাংস পিন্ড।

মাতা পিতার প্রতি দায়িত্ব সম্ভদ্ধে আল্লামা সৈয়দ আলী রজা (রঃ) বলেনঃ মাতা পিতা জন্মদাতা গুরু সে নিপুন।

শক্তি নাহি শোধিবারে মাতা পিতার গুন।
কোটি অব্দ প্রাণ শক্তি সেবা যদি করে।
গুরু মা বাপের শোধ নিতে না পারে।
মাতা পিতা গুরু বলি গুরু সে মা বাপ।
এ তিন প্রসাদে সর্ব্ব সিদ্দি মুক্তি লাভ।
আবার মাতা পিতার সম্বন্ধে কবি বলেনঃ
যে সবে মা বাপ সঙ্গে বিবাধ কর।
তাহার কপাল মন্দ সর্ব শাস্ত্রে কয়।
না বলিব কটু উত্তর মা বাপরে।
সেই বড় দোষ না ক্ষেমিব করতারে।
দরবেশ মহিম সম্বন্ধে কবি বলেনঃ
নির্মূল প্রভুর অংশ ফকির জন্মিল
রছুলের অংশ কবি ভুপতি হইল
নর সম নহে যোগী কুল নরোত্তম
আল্লাহর দুর্লভ রত্ন ফকিরি জনম।

কবি ও বিদ্যার মাহাত্ম সম্মন্ধে আল্লামা সৈয়দ আলী রজা (রঃ) বলেনঃ

পাপ ডুবাইতে লোক জন্মিয়াছে ধন।
বিদ্যা জন্মিন্তে পাপ করিতে, মোছন।
কবি কুল বিদ্যা সাধে ঈশ্বর চিনিতে
আলিমের জোক্ত নিত্য আল্লাকে সেবিতে।

এছাড়া ও ব্যবহারিক জীবনের অন্যান্য বিষয় নিয়ে ও কবি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সময়ের অভাবে ও অন্যান্য সমস্যায় তা পাঠক সমাজের নিকট তুলে ধরতে পারছিনা বলে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আশা করি পাঠক সমাজ তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। শাহানামা কাব্যের শেষ চারটি পংক্তি তুলে ধরা হলঃ

গান শকতি জায় মুক্তা বাছি (২) তোলে।
সঙ্গ চিবি চন্ত তোলে নিবালী সকলে।
সে সকল পন্ডিতের খর্গ চারি দ্বার।
দিবর্ব রত্ন মুক্ত তুলি গাতে প্রম হার

পদাবলী সাহিত্য: ভারতে এসে এদেশী ধর্ম আচার ও দর্শনের প্রভাবে পড়েছিল দির্ব্ব রত্ন মুক্ত তুলি গাতে গ্রেম হার। মুসলমানরা রমন্সীতা ও রাধা কৃষ্ণের রুপকে বান্দা আল্লাহর তথা জিবাত্মা- পরমাত্মার সম্পর্ক, ভক্তি, প্রেম, বিরহ বোধ কিংবা মিলনাকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন মধ্য-উত্তর ভারতীয় মুসলমানরা। বাংলাদেশেও দেশজ মুসলমানরা পূর্ব সংস্কার বলে চৈতন্যোত্তর যুগে ভাবসদৃশ্য বশত সূফীতত্ত্বের রুপক হিসাবে আধ্যাত্মপ্রেম বা হৃদয়াকুতি প্রকাশ করেছেন রাধা কৃষ্ণ প্রতীকের মাধ্যমে। সাধক আলী রজার মতে মানব দেহই রাধা আর মন হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণ।
সূফীমতের আংশিক সাদৃশ্য রয়েছে রাধা কৃষ্ণ লীলায়। তাই একেশ্বরববী ও. অবতারবাদ আস্থাহীন মুসলমান কবিগণের কল্পনায় সাধারণত রাস, মৈথুন, বস্ত্রহরণ দান, সম্ভোগ, বিপ্রলদ্ধা প্রভৃতি প্রশ্রয় পায়নি।
কেবল রূপানুরাগ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন, বিরহ, প্রভৃতিকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক সূচক ও ব্যঞ্জক বলে। তাদের রচনায় অনুরাগ, বিরহ বোধ এবং জীবন জিজ্ঞাসায় (আত্মবোধন) বিশেষ রূপে প্রকট। সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে এটিই রূপ। এ সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক বোধজন্মে এটিই অনুরাগ, এবং তাঁর প্রতি কর্তব্য বুদ্ধি জাগে এটিই বংশী, আর সাধনার আদি স্তরে পাওয়া না পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে তারই প্রতীক নৌকা এর পরে ভাব প্রবন মনে উপ্ত হয় আত্মসমর্পন ব্যঞ্জক সাধনার আকাঙ্খা- এটিই অভিসার। এরপর সাধনায় এগিয়ে গেলে আসে আধ্যাত্ম স্বস্তি তাই-মিলন। এর ও পর জাগে পরম আকাঙ্খা একান্ত হওয়ার বাঞ্চনা এর নাম বাকা বিল্লাহ্ এ-ই বিরহ। সাধক কবি আলী রজার প্রধান খ্যাতি নির্ভর করিতেছে তাঁহার পদাবলীর উপর। তিনি যে একজন প্রতিভাধর পদকর্তা তাহাতে দ্বিমতের অবকাশ নাই। সঙ্গীত কলা সম্মন্ধেও তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। তাঁহার “ধ্যানমাল” রাগতালের গ্রন্থ। কিন্তু তাহার ভণিতায় যে সমস্ত বৈষ্ণব ও শাক্ত পদ পাওয়া গিয়াছে তাহার কাব্য মূল্যও ভক্তি রস বিশেষ প্রশংসনীয়। সাধক কবি আলী রজার দুই একটি বৈষ্ণবপদ যে কোন প্রথম শ্রেণীর বৈষ্ণবপদের সমকক্ষ, কোনটি বা দুর্লভ উৎকর্ষে প্রশংসনীয়। রাধার ব্যাকুলতা কবি কত অল্প ভাষনে ফুটাইয়াছেনঃ

বনমালী, কি হেতু রাধারে ভাব ভিন
তোমার প্রেমে যায়, দগধে জীবন যায়
নিত্য রাধার মদন অধীন।

বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত (তৃতীয় খন্ড) ডঃ অসীত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবি আলী রজা (রঃ) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন। “মধ্যযুগে যথার্থ বৈষ্ণব কবি বলতে হলে, সৈয়দ মর্তুজা, নাসির মামুদ, ও শাহ আলী রজার নাম উল্লেখ করতে হয়। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবির সংখ্যা শত খানেক হবে, তাদের মধ্যে উল্লেখিত কবি ত্রয়ের পদ বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য সুপরিচিত”।
আলী রজা শুধু পদকর্তা হিসাবে নয় তাত্ত্বিক সাধক রূপেও এক যুগে বিশেষ ভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। ইনি দরবেশ শাখা ভুক্ত হলেও হিন্দুর তন্ত্র ও যোগ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। এই জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সমপ্রদায় তাহার শিষ্য হয়েছিল। তার পাঁচ খানি গ্রন্থে (জ্ঞান সাগর, সিরাজ কুলুব, ধ্যানমালা, যোগকালান্দর ঘট চক্রভেদ) হিন্দু ও মুসলমান সাধনার যুক্তবেনী রচিত হয়েছে। এর মধ্যে “জ্ঞান সাগর” আধ্যাত্মবাদী গ্রন্থ হিসাবে সুপরিচিত। এতে ইসলামী সূফি ও হিন্দুর যোগতন্ত্রাদীর সমন্বয় করার চেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিন্তু আলী রজার জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি নির্ভর করিতেছে তাঁহার বৈষ্ণব পদের জন্য।
তাঁহার ভণিতায় কয়েকটি শক্ত পদ পাওয়া গিয়েছে। এই সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে সাদক আলী রজাকে এক অসাধারন ব্যক্তি বলে মনে হইতেছে। এই রকম অসাম্প্রদায়িক, উদার ও আধ্যাত্মমার্গের কবি ও সাধক মধ্যযুগের মুসলমান সমারজ দুর্লভ। যেমন- এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর।

এক তন এক মন আছে একেশ্বর।
ত্রিজগতে এক কায়া এক করতার।
এক প্রভূ সেবে জপে সব জীবধর।

হিন্দুর যোগ দর্শন ও মুসলমানের সুফী দর্শনকে মিলিয়ে শাহ্ সুফি সৈয়দ আলী রজা এমন সমস্ত পদ লিখেছিলেন যার তত্ত্ব মূল্য উভয়ই বিশেষ প্রশংসনীয়

প্রেমনন্দ সিংহাসন প্রেম রস বিন্দাবন
প্রেমনন্দ তরুমূল প্রেমানন্দ
ফলফুল প্রেমানন্দ রস মধুকর।

এসব রচনা নিষ্ঠবন সহজিয়া বলে মনে হচ্ছে। বৈষ্ণবদের স্বকীয়া পরকীয়া তত্ত্ব কবি বেশ ভাল ভাবেই জানতেন এবং পরকীয়া রসের পক্ষপাতী ছিলেন, তা এই দুই ছত্র থেকে বুঝা যায়।

স্বকীয়ার সঙ্গে নহে অতি প্রেমরস।
পরকীয়া সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস।

তার রাধা কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী রচনার দিক থেকে অধিকতর প্রশংসনীয় এই পংক্তিগুলি কি শ্রেষ্ট বৈষ্ণব কবির রচনা বলে মনে হয় না।

বনমালী, কি হেতু রাধারে ভাব ভিন
তোমারে প্রেমে যায় দগ্ধ জীবন যায়
নিত্য রাধার মদন অধীন
কিংবা রাধার আক্ষেপোক্তি
কি খেনে আসিলাম ঘাটে
নন্দের নন্দন ভুবন মোহন
দেখিয়া মরম ফাটে
কুলাবতী যত নারী গৃহবাস দিল ছাড়ি
শুনিয়া দারুন বংশী, স্বর
জাতি ধর্ম কূলনীতি তেজি বন্দু সব পতি
নিত্য শুনে মুরলীর গীতি
বংশী হেন শক্তি ধরে তনু রাখি প্রাণী হরে
বংশী মূলে জগতের চিত।

সাধক কবি সৈয়দ আলী রজা কিছু কিছু শাক্ত পদও রচনা করেছিলেন একটি পদে দান বদলনী চন্ডিকার বীরঙ্গনা মূর্তি চমৎকার ফুটিয়াছে।

অষ্ট অলঙ্কায় চন্ডী করি পরিধান
মহানন্দে লৈল গৌরী যুদ্ধের সাজন
সিংহ আরোহন কালী হস্তেত কৃপাণ
সুরবর্ণ ত্রিণয়নী সমরে পয়ান।
যুদ্ধে প্রবেশিলা দেবী মন্দ মন্দ হাসি
রক্ত পালে মত্ত অসূর কার্যে রাশি রাশি।

ব্রজসুন্দর সান্যাল আলী রজার কবিত্ব সম্মন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন আল্লামা আলী রজা কেবল প্রেমিক নহেন, তিনি ভক্ত ও বটেন এ মন্তব্য অযৌক্তিক নহে। আসল কথা অসাম্প্রদায়িক উদার মতি আলী রজা হিন্দুর আধ্যাত্মবাদে উত্তমরূপে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। সেই দিক দিয়া তিনি তাত্বিক ও দার্শনিক। অপরদিকে তিনি আবার ভক্ত কবি। তত্ত্ববাদ ও ভক্তি রস তাঁর পদ সাহিত্য আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। পদাবালীতে কবির ভণিতা বিশেষ অর্থবহ ও উল্লেখ যোগ্য-

গাহে আলী রজা হীনে রাধা সম ত্রিভূবনে
প্রেমভক্ত নহে দেব মুনি
জীবযত পরী নর এক নহে সমস্বর
কুল ভক্ত রাধার নিছনি।

ধ্যানমালা: ইহা একটি সঙ্গীত শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ। বাঙ্গালীর প্রাণের ঐশ্বর্য যখন বৈষ্ণব ও সুফী আন্দোলনের মাধ্যমে ভাগবত উৎকণ্ঠার নিবৃত্তি সাধনে তৎপর ছিল এবং সেভাবেই ব্যয় হয়েছে তখন আমাদের সংগীত কলা নতুনের স্পর্শে বিশেষ পায়নি। গতানুগতিক ধারাতেই চলছিল। তারই প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের রাগ তালে নানা গ্রন্থে, তবু সূর্য উদয় হলে যেমন তার রশ্মি ছিদ্র পথে ও প্রবেশ করে তেমনি আমাদের সঙ্গীত কলায় ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যে দেখা গেছে। তার প্রমাণ পাচ্ছি কিছু কিছু মিশ্র রাগরাগিনিতে যা ছয় রাগ ছত্রিশ, রাগিনীর অতিরিক্ত যেমন ধানসী বেতগরা ধানসী দীপিকা, ধানসী- কেদার দানসী দ্রোপদী সহ মোট ৪০টির ও বেশী সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ গুলো বিশ্লেষন করলে এতে কয়েকটি অংশ পাওয়া যায় যেমন রাগের ড়গাই রাগনাম বা “রাগমালা”তাল সম্বন্ধীয় গ্রন্থের নাম তালনাম এবং রাগ ও তালের মিশ্র গ্রন্থের নাম “রাগতালমালা” রাগ তালমালার অষ্টাদশ শতকের অন্যতম আল্লামা কবি সৈয়দ শাহ্ আলী রজা উপরোক্ত প্রত্যেকটি শাখায় সঙ্গীত রচনা করেন।
সূফী সম্প্রদায়ের মাধ্যমেইমুসলিম সমাজে সঙ্গীত কলার চর্চা প্রতিষ্ঠা পায়, তার সংস্কৃতি সঙ্গীত শাস্ত্রে তাদের আদর্শ ছিল। সংস্কৃতি সঙ্গীত শাস্ত্রে সঙ্গীতের পৌরাণিক উদ্ভব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সঙ্গীত ও শিবপ্রোক্ত। মুসলমান সঙ্গীত তাত্ত্বিক গণ সংগীত সৃষ্টি করেন। এ প্রসঙ্গে সাধক আল্লামা কবি সৈয়দ আলী রজা বলেন।

গোপ্ত ব্যক্ত মহামন্ত্র রসুলে হোতে।
চারিবেদ চৌদ্ধ শাস্ত্র করিল জগতে।
বহু বহু কাল সেই আছিল গোপেতে।
ভাবিনী ভাবক হই শঙ্কর সাক্ষাতে
তারপরঃ শঙ্কর প্রণমি নবী মর্ত্যেতে আসিল
বেকত সকল কথা সভাত কহিল।

কিন্তু একদিন আলীর অনুরুধে নবী গোপতত্ত্ব ও মন্ত্র আলীকে না দিয়ে পারলেন না। আলী সে মহা মন্ত্রের তেজ সহ্য করতে না পেরে নবীর পরামর্শে গভীর
অরন্য মন্ত্র রেখে এলেন।

এদিকে মন্ত্র শুনি কম্পি গিরি বহে জলাধার
মহা জলাকা হৈল জঙ্গল ভিতরে
সে জল খাইল যথ বনের বানরে
জলপানে হনুমান মহামত্ত হইয়া
লক্ষিবারে লাগিলেন্ত বৃক্ষেত উঠিয়া
লাফাইতে বৃক্ষখাতে যথ হনুমান
উদর ছিঁড়িয়া কত তেজিল পরাণ।

কিন্তু গাছে গাছে বানরের রগ (শিরা নাড়ী) সব রহে টানা দিয়া এবং যখন বসন্ত ঋতু এল তখন চারিদিকে সুরের ঝংকার উঠল। কবির ভাষায়

সে রগে লাগিল যদি মলয়া বা ও
কহিতে লাগিল তাল যন্ত্র রাও
বসন্ত সমীর সেই রগেত লাগিল
ঋতু রাগ তাল নামা যন্ত্র নিঃসরিল
দগর, নাগর (নাকাড়া) ঢোল কথ বাধ্যধ্বনি
রবাব দোতারা, বংশী, সানাই বেগুনী।
ভেওর কন্নাল যথ রস বাদ্য বঙ্গ।
পিনাক ডুম্বর বেনু কর্তাল মৃদঙ্গ।
নহবত ঝাঞ্জারি বাদ্য যথেক সংসারে।
ব্যক্ত কৈল হনুমান হোন্তে করতারে।
রাগ তাল গোপেত আছিল হর পাশ।
হনুমান হোন্তে হৈল সংসারে প্রকাশ।
তারপরঃ- আর দিন নবী কহে মর্তুজার ঠাঁই।
মন্ত্র যথা ছাড়ি দিছ দেখ তুমি যাই।
নবীর আদেশে আলি যেই বনে গেল।
ঋত রাগ যন্ত্রতথা বাজিতে দেখিল।
নানা রাগ যন্ত্র দেখি মহানন্দ আলি।
সকল শিখিল শাহা হৃদয়ে আকলি।
সারিন্দা করিল মৃত কপি অঙ্গ আনি
বানরের চর্মে দিল সারিন্দার ছানি।
বানরের রস দিয়া রবাব সাজায়।
সারিন্দায় মন্ত্র শাহা প্রথমে শিখিল।
পাছে রাগ তাল সব অভ‍্যাস করিল।

বিধৃত অংশে দেখা যাচ্ছেঃ আল্লাহই শঙ্কর বা শিব। তিনি হযরত মুহাম্মদকে বেদাদী চতুর্দশ গুপ্তব্যক্ত শাস্ত্রেও মন্ত্রে জ্ঞান দান করেন। হযরত আলী এ জ্ঞানের উত্তরাধিকার পান এবং মহামন্ত্রের তেজ সহ্য করতে না পেলে রাসুলের অনুমতিক্রমে বনে রেখে এলে, সেখানে জলাধার সৃষ্টি হয়। সে জলাধারে পানি পান করে হনুমান এর আত্মাদানে রাগতাল বসন্ত সমীর সহযোগে পৃথিবীতে প্রচারিত হয়। এবং নরমধ্যে আলীই আবার আদি সঙ্গীতজ্ঞ। সঙ্গীত যে ভাবগত উৎকণ্ঠার তথা আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা নিবৃত্তির ও সাধনার বাহন তাও আলী রজা স্পষ্ট করে বলেছেন।

আলী হোস্তে সে সকলে সন্নাসী ফকিরে।
শিখিল সকল যন্ত্র রহিল সংসারে।
ভাবের বিরহে সব শান্ত হৈতে মন।
রাগতাল কৈল প্রভু সংসারে সৃজন
গীতযন্ত্র শুনি মহামুনি ভ্রম যা এ।
সর্ব দুঃখ দূর হয় গীত যন্ত্র রা এ।
গীতযন্ত্র মহামন্ত্র বৈরগীর কাম।
রাগযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভূর নিজ নাম।
জীববন্ত যথ আছে ভুবন ভিতর।
সর্ব ধর্মে সর্ব ঘটে গীতের সুস্বর।
ঘটে গোপ্ত যন্ত্র গীত যোগীগণে বুঝে।
তেকারণে সর্ব জীবে সে সবারে পুজে।
গীতযন্ত্র সুস্বর বাজায় যে সকলে।
মহারসে ভূলি প্রভূ থাকে তার মেলে।
শুদ্ধ ভাবে ডুবি নৃত্য করে যেই জনে।
গীত রসে মজি প্রভূ থাকে তার সনে।

মুসলিম সমাজে সঙ্গীত চর্চা যে সূফী প্রভাবেরই ফল, আমাদের সে অনুমান উক্ত চরণ কয়টির দ্বারা প্রমাণ সিদ্ধ হল।

রাগ নামা:-
সৃষ্টি পতন গুর
আরম্ভঃ সুন, সুন, গুনিগন সুন দিয়া মন
সৃষ্টি পতন কহি শুন বিভরণ মহা প্রভু জখনে য়াছিল এক সর
নয়াছিল উত্তরের দিকে প্রদুত্তর।
ভণিতাঃ রাত্রিতে চলেন গাঁদ এক বিংশ রাগ
হিন আলী রজা কহে এই মত ভাগ

রাগমালাঃ আরম্ভ-

-হ-এ রমনের গতি
পঞ্চম নাসাতে হ, এ হিল্লোল সুমতি
অষ্টম নাসাতে হ, এ কর্ণাট নৃপতি।
দুই মাসে’—— চিতবারি আছে গতি
ভনিতাঃ শাহা কেয়ামুদ্দিন পদে করি ধ্যান
কহে আলী রজা দিন ভাগের বয়ান।

সাধক কবি শাহ সুফি আল্লামা সৈয়দ আলী রজার স্বরচিত কয়েক শত আধ্যাত্মমূলক ও পরমার্থিক সঙ্গীত রচনা করেন। তাঁহার এই গীতগুলো বড় সুন্দর। এদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য গান গুলো নিম্নরুপঃ

১) শ্যাম কালারে অবিরতে জলেরে সাম ভাবনা।
২) দেহের মাঝে কানুর মন মজিল রে, চল কানু এবে দেশে যায়।
৩) রাধা কানু সর্বত্রে বিলাসী রাধী কার মনের মাঝে, কালিকা শ্যামের বাশি।
৪) নাগর বন্ধুয়ারে হাউসের পীরিতি কেনে ভাঙ্গিলেরে।
৫) ভাবনারে এতিন জ্বাল, শ্যামের পিরিতীর ভিষম জ্বালা।
৬) হারিয়া লৈ গেল জাতীর কুল, মদনের বাশী,
৭) লুক লুক পোলামী সই লুক লুক পোলামী
৮) ডুবালি ডুবালি জাতির কুল, দারুনির বউরে
৯) দারুন মনরে বুঝায় তোরে গুরু বিনে বান্ধম না এই সংসার।
১০) বোল মন কিহালে হাকিক ততরী, ২পোহাইলে লই যাইব ধরি।
১১) কালা তোমার ভাল জানি (২) তোমার সঙ্গে প্রেম করি হৈলাম কলংকিনি
১২) প্রাণের ঠাকুর গো তুমি বিনে ভাবে কি আমার।
১৩) সততে বন্ধের লাগি জ্বলে অবলার চিত্যরে।
১৪) ছাড় মন দুনিয়ার খোলা পাপ দুনিয়ার ভীষন জ্বালা
১৫) পিয়াহে তুমি বিনে কেজানে মরণ নাটে নিত্যবাজ স্বর নিন্দি অলি সম,
১৬) জ্ঞান সিন্ধু সম শাহা কেয়ামুদ্দিন পীর মোহাকল্প তরু সিদ্ধ করুনা সুধির। ইসলাম নামা: ইহা ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় লিখিত।
ষটচক্র ভেদ ও যোগ কালন্দর:- উভয় যোগ শাস্ত্রীয় বিষয়ক গ্রন্থ।
সৃষ্টি পত্তনঃ- সৃষ্টির রহস্য বিষয়ক গ্রন্থ।
খাবনামাঃ- ইহা জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ।
অমর সিংঃ- ইহা রোগ নির্ণয় বিষয়ক গ্রন্থ। এছাড়া ও কবিরাজী চিকিৎসা শাস্ত্রীয় বিষয়ক গ্রন্থ রহিয়াছে। আল্লামা আলীরজা (রঃ)রফিকুচ্ছালেকীন, রাহাতুর রুহ, তারিফে রাসুল (দঃ) সহ মোট ১০টি কিতাব বংশধরদের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে উহার আলোচ্য বিষয় আমাদের বোধগম্য নয়।
উপরোক্ত গ্রন্থ ছাড়াও হযরতুল আল্লামা পীর, মীর সৈয়দ আলী রজা (রঃ) এর স্বরচিত বিভিন্ন ধরনের দাওয়াত, দরুদ, কেয়াম মিলাদ, জিকির ছাড়া ও ঈদুল আযহার খোতবা, সুরা ফাতেহার তাফছীর, বিভিন্ন হাদিছ সহ মুরীদ ও তলকীন করার নিয়ম বিষয়ক অনেক কিতাব পীর মশায়েখদের নিকট সংরক্ষিত রয়েছে।
অষ্টাদশ শতকের অন্যতম কবি, আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধক হযরতুল আল্লামা শাহ্ ছুফি সৈয়দ পীর মীর আলী রজা (প্রকাশ কানু শাহ) (রঃ)’ এর স্বরচিত গ্রন্থ ও কিতাব সমূহ বর্তমানে তাঁহার বংশধরদের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলা একাডেমী ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কবির রচিত তিনটি গ্রন্থ ও কয়েকটি মুসলিম বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশ করেন। কিন্তু কবির রচিত অধিকাংশ বই এখনো পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ও প্রকাশিত হয়নি। সরকার বাংলা একাডেমী গবেষক পীর মশায়েখ, বংশধর ভক্ত ও পাঠক সমাজের ঐকান্তিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সাধক কবির সবকটি গ্রন্থ প্রকাশ করে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যকে পূর্ণাঙ্গতা প্রদান করা আবশ্যক। পাশাপাশি তাঁহার ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহ সংস্করণ করে আল্লাহ রাসুল ও আউলিয়া কেরাম সম্মন্ধে জ্ঞান অর্জন করে ইহকালীন শান্তি লাভ করা সম্ভব। কেননা তাঁহার সমস্ত কাব্যই আধ্যাত্মিক জ্ঞান ইসলামী শরীয়াহ তথা আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশিত বিষয় নিয়ে রচিত। সুতরাং উপরোক্ত বিষয়ে সুধী সমাজের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কানু শাহ্ (রঃ) হযরতুল আল্লামা শাহ্ ছুফি সৈয়দ আলী রজা (প্রকাশ কানু শাহ) (রঃ) এর সর্ব শেষ্ট অবদান তাঁহার নির্দেশিত “বিষু মোবারক” প্রতি বছর আষাঢ়ের শেষ তারিখ ও পৌষের শেষ তারিখ “বিষু মোবারক” পালিত হয় ইহা কেবলমাত্র বাবাজান কেবলার তরিকত পন্থীদের জন্য প্রযোজ্য বিধায় সর্ব সাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা সম্ভব হল না। তথাপি বিষুর তাৎপর্য সম্মন্ধে বাবাজানের বর্ণনা তুলে ধরা হল।

মূল ফুল যুগ বিয়ু কেদার উত্তরে
জল স্থল বিষু দুই আদিতের ঘরে।
ইহার অন্তরে আর দুই বিষু হয়।
ষষ্ট রিতে ছয় বিষু আলী রজা কয়।
বিষু ঋতু সকলে জানে দৃঢ় মতে জিয়ন মরণতত্ত্ব পাইব বুজিতে।
আবারঃ বিষু ঋতু ভাগমর্ম যে সকলে জানে
জিয়ন মরণ পন্থ শুদ্ধ মতে চিনে
জিয়ন মরণ মূল ষষ্ঠ ঋতু মাজে।
অমূল্য রতন ঋতু কহে মুন রাজে। (জ্ঞান সাগর)
বিষুর নিয়ম কানুন এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবাজান কেবলা বলেনঃ-
হেমন্ত বসন্ত যদি না থাকে মিলন।
মন প্রভু তখনে তেজিব সিংহাসন
ষষ্ঠ ঋতু মধ্যে রাজা হেমন্ত বসন্ত।
শক্তি নাহি কবি কুরে জানিবার অন্ত।
বিষুরে চাহিবা লোকে হই সাবধান।
মুখে শুনিয়া তাহার পরিমাণ। (জ্ঞান সাগর)

#গুরু_ওফাৎ_দিবস: বাবাজান কেবলা শাহ্ সুফি সৈয়দ আল্লামা আলী রজা (রঃ) ১১৯৯ মঘীর ৫ই মাঘ, ১৯শে শাওয়াল মোতাবেক ১৮৩৭ ইংরেজী রোজ বুধবার ৭৮ বছর বয়সে নশ্বর পৃতিবী ত্যাগ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Design & Developed by : BD IT HOST