রাজধানী ঢাকায় যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতি অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। পরিস্থিতির উন্নতি হলে যার অনেকটাই সাশ্রয় হবে। স্বস্তি মিলবে নগরজীবনেও। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রতিদিনের প্রায় ২ কোটি ট্রিপের ৭০ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে বাসে। রাষ্ট্রের একক মালিকানায় চালাতে হবে সব বাস। রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা। দুই সিটিতে মোট ১২০টি বাস স্টপেজ নির্ধারণ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। তারপরও নির্ধারিত স্থানে বাস না থামার কারণ জানতে গেলে কেবলই অভিযোগের কাদা ছড়াছড়ি যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিকদের।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ের চারদিকে কাঠামোতে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি লাগানো রয়েছে। কিন্তু এসব বাতি সচল না অচল কেউ জানে না। অনেক স্থানে আবার দেখা যায় লাল বাতি জ্বললেও গাড়ি চলে সবুজ বাতি জ্বললেও গাড়ি চলে। রাজধানীতে চলাচলরত গাড়ির চালকরাও এখন ট্রাফিকের হাতের ইশারায় চলতে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। এখন আর তারা সড়কে ট্রফিক সিগন্যালের কথা চিন্তা করেন না। সমন্বয়হীনতা আর প্রক্রিয়ার গলদের কারণে কাজে আসছে না রাজধানীর কোটি কোটি টাকার স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা। রাজধানীতে গাড়ির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বর্তমানে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গাড়ি ঢাকার সড়কে চলছে। এতে ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থা। আধ ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। নগরীতে চলাচল করে লাখ লাখ যান্ত্রিক যানবাহন। পাশাপাশি আছে প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। নগরীজুড়ে যত্রতত্র পার্কিং, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, অবৈধ যানবাহন চলাচল করার কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনা, প্রতারণা কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে মাশুল গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকেই। অসহনীয় এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবার উদ্যোগী হলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সঙ্কট সমাধানের উপায় খুঁজতে দায়িত্ব দিলেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের। প্রাথমিকভাবে ৬ দফা রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তারা। তবে বলা হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রয়োজন গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করা। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা। সঙ্কট নিরসনের রূপরেখা খুঁজতে দেশিয় ও স্বল্প খরচে সমাধানের পথে হাটতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। উপায় খুঁজে বের করতে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব দেন বুয়েটের দুই বিশেষজ্ঞকে। এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ছয় দফা প্রস্তাবনা। পরিকল্পনা আছে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে হাইকোর্ট মোড় থেকে আবদুল্লাপুর পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে কার্যকরের। এই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখভালের মূল দায়িত্ব পালন করবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ আর বাস্তবায়নে থাকবে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ।
৬ দফা রূপরেখায় বলা হয়- প্রধান সড়ক থেকে নিবন্ধনহীন রিকশা, অটোরিকশা ও ইজি বাইক অপসারণ। ট্রাফিক পুলিশকে আইন প্রয়োগে সক্রিয় করা। প্রতিটি রাস্তার মোড়ের ৫০ মিটার ও গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কে ১০০ মিটারের মধ্যে যানবাহন পার্কিং না করা। নির্ধারিত স্থানে সুশৃঙ্খলভাবে যাত্রী ওঠা-নামা নিশ্চিত করা। কম ব্যস্ত সিগনালে ২ থেকে ৩ মিনিট এবং ব্যস্ত সিগনালে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট সিগনালসাইকেল নিশ্চিত করা। তাৎক্ষনিক সমস্যা সমাধানে ৬ থেকে ৮ টি ভ্রম্যমাণ ট্রাফিক মনিটরিং টিম গঠন করা।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের রিসার্চ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রায় ২৫০টি বিভিন্ন ক্যাটাগরির ট্রাফিক অফিস, ট্রাফিক বক্স, ট্রাফিক ইনফরমেশন ও সার্ভিস সেন্টার, ট্রাফিক এডুকেশন সেন্টার এবং ট্রাফিক ট্রেনিং পার্ক স্থাপন জরুরি। ডিএমপি ট্রাফিক কারিগরি ইউনিটে ৩৯টি পদ রয়েছে। আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য এসব পদে ছয় হাজার ট্রাফিক জনবল সংস্থাপন, লজিস্টিক সাপোর্ট, আধুনিক ট্রাফিক কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা দরকার। টেকসই ও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে অবশ্যই ডিএমপি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে ট্রাফিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম, ট্রাফিক মিডিয়া ও তথ্য সরবরাহ সেন্টার, ট্রাফিক মোবাইল লাইভ অ্যাপসহ বিভিন্ন দেশের আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রশিক্ষণ আয়োজনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও প্রকল্প নিতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের সক্ষমতাবৃদ্ধির নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ট্রাফিক অবকাঠামো, ট্রাফিক বিভাগের প্রকৌশলগত বিষয়গুলো, রাস্তায় চলাচলরত সব যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পার্কিং নীতিমালা, রাস্তায় গাড়ির ধারণ ক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ প্রভৃতি দায়িত্ব বিআরটিএ ও বিআরটিসির। ফুটপাথ, পার্কিং নীতিমালা, বায়ুদূষণ, বাস-বে, বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, সরকারি ডাম্পিং স্টেশন, ট্রাফিক সিগন্যাল ও পথচারীদের নিরাপদ পারাপার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করিডর ব্যবস্থাপনাসহ প্রায় সব বিষয়ের ব্যবস্থাপনা ঢাকা সিটি করপোরেশন, সেতু বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় করে থাকে। ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য বহু বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা সফল হতে পারেনি।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়কে ট্রাফিক পুলিশ রেখেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আমাদের যে পরিমাণ বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা আছে সেখানে ব্যাকরণ কাজ না করে আধুনিক কিছু চাপানো যাবে না। আমরা যেটি চিন্তা করছি সেটি হচ্ছে অনেকটা সেমি-অটোমেটেড। ফ্লেক্সিবল সিগনাল লাইট বলছি। এখানে অটোমেশন থাকবে আবার সেই সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ ম্যানুয়ালি এটি টাইম পরিবর্তন করতে পারবে। সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে বাসগুলো রুট পারমিট নেই সেই বাসগুলোকে রুট থেকে বের করে দিতে হবে। যেই বাসগুলো চলার উপযোগী সরকারকে সেগুলো নিয়ে প্রথম কাজ করতে হবে। ধীরে ধীরে বিনিয়োগ হবে এবং বাসের মান পরিবর্তন হবে, আলাদা লেন থাকবে। চাইলে সিগনালে তাদের প্রায়োরিটি দেয়া হবে। তখন বাসগুলোকে একটা শৃঙ্খলায় আনা যাবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, যখন মানুষ সিগনালে অভ্যস্ত হবে তখন একজন কনস্টেবল পুরো ট্রাফিক সিগনালটা কন্ট্রোল করতে পারবে যেখানে বর্তমানে ৫ জন কাজ করে। তবে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাকি ৪ জন অন্য বাকি কাজগুলো দেখভাল করতে পারবে। তখন মানুষ ইচ্ছা করে সিগনাল অমান্য করবেন না। পুলিশ আইন প্রয়োগ করে কখনই ট্রাফিক সিস্টেম উন্নত করতে পারবে না। চালক এবং যাত্রী যদি আইন মানে তখন পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে সুবিধা হবে আর ট্রাফিক সিস্টেমও উন্নত হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত সড়ক, রেল ও নৌ-পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গড়ে ওঠেনি নিরাপদ-জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা। গণপরিবহন খাতকে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে রেখেছে স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, অপেশাদারী ব্যবস্থাপনার কারণে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ হতাহত হচ্ছে। রাজধানীর গণপরিহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস চালুর উদ্যোগ সফল হয়নি এই স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কারণে। অথচ কয়েক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ সত্ত্বেও দুর্নীতির কারণে এই দুটি খাত লোকসানে ডুবছে।